বাংলাদেশে কোভিড ১৯ পরিস্থিতির উন্নয়নঃ সামাজিক পুঁজির যথার্থ ব্যবহার প্রয়োজন : আরিফুর রহমান
বাংলাদেশে সামাজিক পুঁজির যথাযথ ব্যবহার দিন দিন ম্লান হচ্ছে। দেশের স্থায়িত্বশীল বা টেকসই উন্নয়নে সামাজিক পুঁজি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। যে দেশ সামাজিক পুঁজি ব্যবহারে যতবেশি সমৃদ্ধ সে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের সম্ভাবনা ততবেশি উজ্জ্বল।
মূলত সামাজিক পুঁজি হচ্ছে মানুষের মনোজাগতিক এবং ব্যবহারিক অংশগ্রহনমূলক একটি ধারনা ও চর্চা বিশেষ করে, যে দেশের মানুষের মধ্যে পারস্পরিক সামাজিক বন্ধন ও অংশগ্রহন অত্যন্ত নিবিড় সে দেশ সামাজিক পুঁজির উদ্ভব ও সঠিক ব্যবহারের দিক দিয়ে ততবেশি সমৃদ্ধ। যেমন: কোনো একটি মহাসড়কে যদি মারাত্নক দুর্ঘটনা ঘটে তাহলে আশেপাশের মানুষ স্বপ্রণোদিত হয়ে উদ্ধার কার্যে ব্যাপৃত হয়। এই যে, স্বপ্রণোদিত হয়ে এগিয়ে আসা, সহযোগিতা করা এটাই হচ্ছে সামাজিক পুঁজি। আবার বাংলাদেশে কোনো দূর্যোগ (যেমন ভূমিকম্প,বন্যা, পাহাড় ধ্বস) সংঘটিত হলো। এসময় বাংলাদেশের একটি অঞ্চলের অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে কানাডার টরেন্টোতে বসবাস করা একজন প্রবাসী ফেসবুকে একটি আহবান জানাল। যার মাধ্যমে প্রবাসীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হলো চিকিৎসা, খাদ্য সহায়তার জন্য তহবিল। এই যে, স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে সকলের এগিয়ে আসা ও অংশগ্রহন করা এটাই সামাজিক পুঁজি। অনুরূপভাবে সামাজিক বিপদ-আপদ, আনন্দ-উৎসবেও মানুষ মানুষের জন্য স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সাহায্য সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসে। এর ফলে সমাজ ও রাষ্ট্রে একটি সুস্থ আনন্দদায়ক ও অংশগ্রহনমূলক পরিবেশ বজায় থাকে। আগের দিনে মানুষ সার্বজনীন উপকারে এগিয়ে আসতে সবসময় সরকারের দিকে চেয়ে থাকত না। ছোট ছোট রাস্তা ঘাট, ব্রিজ কালভার্ট, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ইত্যাদি অবকাঠামো তারা নিজেরাই তৈরী করে দিতো। এমনকি দুস্থ, এতিম শিক্ষার্থীদের বৃত্তি প্রদান, দুস্থ মেয়ের বিয়ে শাদীর জন্য অর্থ সংগ্রহ করে বিয়ে দিতো। কৃষকের জমিতে ফসল তোলার সময় হলে প্রায় দেখা যেতো গ্রামের সাধারণ মানুষ উদ্যোগী হয়ে সেই ফসল তুলে দিতো, ধান মাড়াই করে দিতো। সময়ের সাথে সাথে মানুষের মনমানসিকতার ও কাজের ধরনের রূপান্তর ঘটেছে। মানুষ এখন আগের তুলনায় অনেকটা স্বার্থপর হয়ে গেছে। মানুষের লোভ বাড়ছে, বিবেক কমছে। মনুষ্যত্বকে মানুষ অবজ্ঞা করছে। সামাজিক পুঁজির যথাযথ ব্যবহার কমে যাওয়ায় মানুষের সামাজিক মূল্যবোধ ও সহভাগীতার বোধ অনেকটাই কমে এসেছে। মানুষ টাকা বা নিজস্বার্থ ছাড়া কোনো কাজ করতে চায় না।
আমরা এখন এক অপরিচিত সময়ের ও চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি। কোভিড ১৯ এর জ্যামিতিক হারে স্বাস্থ্যগত ও সামাজিক সংক্রমণের কারণে লক ডাউন শুরু হলেও মানুষকে ঘরে আটকে রাখা যাচ্ছে না। কারন প্রথমত: এখনো মানুষ কোভিড ১৯ সম্পর্কে পুরোপুরি সচেতন নয় বিধায় লক ডাউন মানছে না। দ্বিতীয়ত: কর্মহীন ও বেকার হয়ে পড়া মানুষের অন্নের প্রয়োজনে রাস্তায় নামতে হচ্ছে। এতে মানা হচ্ছে না নিরাপদ দূরত্ব ও প্রাসঙ্গিক বিধিনিষেধসমূহ। তাই লক ডাউন যতই দীর্ঘ হবে মানুষের পথে নামার তাড়না ততই বাড়বে। লক ডাউনে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে জনজীবন, দূর্ভোগের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে নুন আনতে পান্তা ফুরিয়ে যাওয়া মানুষদের।
কোভিড ১৯ মোকাবেলায় ও পরিস্থিতির উন্নয়নে সামাজিক পুঁজিকে একটি ইতিবাচক সম্পদ হিসেবে দেখতে পারি। ইতিমধ্যে কোভিড ১৯ এর ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের সহায়তার জন্য এগিয়ে আসা ছোট ছোট ব্যক্তিগত বা সমন্বিত সহায়তার কিছু অনন্য উদাহরন আমাদের আশাবাদী ও উৎসাহিত করছে। সরকারী/বেসরকারী প্রতিষ্ঠান ও পেশাদার উন্নয়ন সংস্থার সহায়তার পাশাপাশি ব্যক্তিগত, সামাজিকভাবে বিভিন্ন সহায়তা প্রদান এ বিপদের মধ্যে একটা ইতিবাচক পরিবর্তনে ভূমিকা পালন করছে। সরকারকে এ প্রশংসনীয় কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে এবং মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহন ও সহায়তা দানের উপর আস্থা ও ভরসা রাখতে হবে।
বাংলাদেশের সব অঞ্চলেই এ স্বত:স্ফূর্ত ও কোভিড ১৯ এর বিধি নিষেধ মান্য করে নাগরিক সহায়তা প্রদান দৃশ্যমান হচ্ছে। উদাহরণস্বরূপ আমরা দেখতে পারি যেমন: চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডে মোঃ আবু তাহের একজন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, স্বউদ্যোগে বন্ধুর মোটর বাইক নিয়ে উপজেলার বিভিন্ন রাস্তা, অলি গলি এলাকায় ঘুরে ঘুরে ভবঘুরে মানসিক ভারসাম্যহীন, বুদ্ধি প্রতিবন্ধীদের খোঁজ নিয়ে নিজ হাতে রান্না করা খাবারের প্যাকেট বুঝিয়ে দিচ্ছেন, চিকিৎসা সেবা দিচ্ছেন এবং তা অব্যাহত রেখেছেন।
কোভিড ১৯ মোকাবেলায় বিপর্যস্ত মধ্যবিত্ত জনগোষ্ঠীর অসহায়ত্ব অনুভব করে চট্টগ্রামের সীতাকুন্ড উপজেলা সদরে ‘মাতৃভূমি’ সামাজিক সংগঠন চালু করেছে ‘মানবিক দোকান – ঈদ স্পেশাল’। করোনার কারনে যেন অসহায়, হতদরিদ্র, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মাঝ থেকে যেন মাহে রমজান ও ঈদ আনন্দ হারিয়ে না যায় এজন্য এ দোকান থেকে ৫০% মূল্যে ক্রয় করতে পেরেছে চাল, সেমাই, নুডলস, চিনি, তেল, পেয়াজ ইত্যাদি নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্য সামগ্রী। তারাও মানবিক সহায়তার জন্য আগ্রহী ব্যক্তিদের মোবাইল নাম্বারে যোগাযোগ রাখতে অনুরোধ জানিয়েছেন।
‘ইকো’ একটি চট্টগ্রাম শহরের স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। এই সংগঠনটি চট্টগ্রাম শহরের পথ শিশুদের রান্না করে খাবার খাওয়ানোর উদ্যোগ নিয়েছে। প্রতিদিনই প্রায় ২০০ পথ শিশুকে খাবার প্রদান করেছে। এ সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে ও সকলের সহায়তা নিয়ে তা অব্যাহত রাখছে।
চাঁদপুর এর হাজীগঞ্জ রামচন্দপুর ‘মিঞা ফাউন্ডেশন’ (এটি একটি পারিবারিক স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠান) এর পক্ষ থেকে নিজেদের আত্নীয় স্বজন ও এলাকার অসহায়, দরিদ্র মানুষের জন্য সহায়তা প্রদানের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। শুরুতে ‘মিঞা ফাউন্ডেশন’ ২৩৫ পরিবারে সহায়তা দিয়েছে। এ সহায়তা কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
এছাড়া মানুষ মানুষের জন্য এ মানবিকতার হাত ধরে অনেক বিত্তবানরা আশে পাশের অভাবী মানুষের তথ্য বা ফোন পেয়ে খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রী পাঠাবার ব্যবস্থা করেছেন। স্বেচ্ছাসেবী অনেক প্রতিষ্ঠান ও সামাজিক ব্যক্তিক একক বা যৌথভাবে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন ও সহায়তা করে যাচ্ছেন। এটাই মানবিকতা, এটাই ভালোবাসা। এটাই আমাদের সামাজিক পুঁজি। মূলত বৈশ্বিক মহামারী করোনা ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের এসময়ে সামাজিক দায়বদ্ধতা ও কর্তব্যবোধ থেকেই উক্ত ব্যক্তি ও সংগঠনগুলো এসব ভাসমান মানুষ, দরিদ্র, হত দরিদ্র, সুবিধা বঞ্চিত পথ শিশু, ঝুঁকিপূর্ন, মধ্যবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের মাঝে সহায়তা প্রদান অব্যাহত রেখেছে। এ মানুষগুলোর অনেকের থাকবার কোনো জায়গা নাই, নেই রান্না করে খাওয়ার সুবিধা। এদের হাতে চাল ডাল তুলে না দিয়ে রান্না করা খাবার দিলে মানুষগুলো বেঁচে থাকবে। যাদের পরিবার নিয়ে রান্না করে খাবার সামর্থ্য আছে, কিন্তু খাবার কেনার সাধ্য নাই। তাদেরকে খাদ্য সামগ্রীর প্যাকেট বিলি করা হচ্ছে। বৈশ্বিক এ দু:সময়ে একজন মোঃ আবু তাহের, মাতৃভূমির মানবিক দোকান, রামচন্দপুর ‘মিঞা ফাউন্ডেশন’ ও ‘ইকো’র মত স্থানীয় সংগঠনগুলো এ কাজটিই মানুষকে ভালোবেসে নি:স্বার্থভাবে নিরলস করে যাচ্ছে। এ ধরনের প্রশংসনীয় উদ্যোগের জন্য আন্তরিকভাবে অভিবাদন ও কৃতজ্ঞতা জানাই।
ইতিমধ্যে দেশব্যাপি সরকারীভাবে ও বিভিন্ন বেসরকারী উন্নয়ন সংগঠন খাদ্য ও চিকিৎসা সামগ্রী বিতরণ করছে। সরকারীভাবে বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষনা করা হয়েছে যা আশাব্যঞ্জক। সরকারের প্রণোদনা কতটা তাড়াতাড়ি, যথাযথভাবে প্রান্তিক বা নিরন্ন মানুষের দোরগোডায় পৌঁছাবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে।
কোভিড ১৯ কোনো রাজনৈতিক ইস্যূ নয়। একটি অভিন্ন স্বার্থের জন্য একই সঙ্গে পাশাপাশি থেকে সেরকারী, বেসরকারী, বিভিন্ন পেশাজীবি, সুশীল সমাজ, কমিউনিটিকে সার্বিকভাবে সম্পৃক্ত করে কোভিড ১৯ প্রতিরোধে ও লক ডাউন সফল করতে স্ব স্ব অবস্থা ও অবস্থান থেকে সমন্বিতভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।
দুঃস্থ ও সুবিধা বঞ্চিত মানুষের পাশে দাঁড়ানো সমাজের প্রতিটি নাগরিকেরই কর্তব্য। রাজনৈতিক দলীয় বিশ্বাস ও ব্যক্তিগত সংকীর্নতা থেকে বেরিয়ে প্রত্যেকের দায়বদ্ধতা থেকেই এসব বিপদগ্রস্ত লোকজনের পাশে দাঁড়াতে হবে। তাদের জন্য কাজ করা বা তাদের পাশে দাঁড়ানোর অনুভূতিটাই অন্তর থেকে অনুভব করতে হবে। অনন্য উদাহরণ হয়ে আরো ব্যক্তি বা সংগঠনগুলো এগিয়ে আসুক ও সমন্বিতভাবে কাজ করুক।
যে বিষয়টি সাধারন নাগরিকদের ব্যতিত করে তুলছে তা হচ্ছে, সামাজিক পুজিঁর অভাবে সমাজের সর্বত্রই বিভাজন ও অস্থিতিশীল সামাজিক অবস্থা বিরাজ করছে। তাই কোভিড ১৯ এর বৈশ্বিক মহামারীতে সামাজিক পুঁজিকে সামাজিক – অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য একটি ইতিবাচক প্রয়োজন হিসেবেই দেখা জরুরী। কেননা কোনো উদ্যোগ বা কার্যক্রম সফলভাবে পরিচালনা করতে হলে সরকারী প্রচেষ্টা ও প্রণোদনার পাশাপাশি সঠিকভাবে সামাজিক পুঁজির বিকাশ ও ব্যবহার এর বিকল্প নেই। মানুষ মানুষের জন্যই এগিয়ে আসুক, যথাযথভাবে দায়িত্ব নিক। এ মানবিকতা নিয়ে মানুষ বাঁচুক, সমাজ বাচুঁক ও রাষ্ট্র বাঁচুক। আমরা করোনা মুক্ত পৃথিবীতে নিরাপদে সকলে মিলে সুখী ও সমৃদ্ধশালী হতে চাই।
লেখকঃ গবেষক ও উন্নয়ন সংগঠক
ই – মেইল: ypsa_arif@yahoo.com